বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত নেত্রকোনা জেলা তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং বৈচিত্র্যময় জীববৈচিত্র্যের জন্য অনন্য। এখানকার পাহাড়, নদী, হাওর, জলপ্রপাত এবং ঐতিহাসিক স্থানসমূহ পর্যটকদের জন্য দারুণ আকর্ষণীয় হতে পারে। সঠিক পরিকল্পনা, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ এবং পর্যাপ্ত প্রচারণার মাধ্যমে নেত্রকোনাকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন গন্তব্যে রূপান্তর করা সম্ভব।
নেত্রকোনার প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক সৌন্দর্যঃ
নেত্রকোনায় রয়েছে অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান, যা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারে। এসব স্থানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিচে তুলে ধরা হলো—
১. বিরিশিরি ও সুমেশ্বরী নদীঃ
দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি এলাকার পাহাড় ও নদী মিলিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য। বিশেষ করে সুমেশ্বরী নদীর নীলাভ পানি এবং তার চারপাশের পাহাড় পর্যটকদের মুগ্ধ করে। এখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের জীবনযাত্রা পর্যটকদের কাছে ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতা এনে দেয়।
২. রানীখং মিশন ও গারো পাহাড়ঃ
দুর্গাপুরের রানীখং মিশন ক্যাথলিক চার্চ এবং এর পাশের গারো পাহাড় ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য দারুণ আকর্ষণীয়। গারো জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, তাদের জীবনধারা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ এখানে পর্যটকদের টেনে আনে।
৩. মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরির হাওরঃ
নেত্রকোনার হাওর অঞ্চলগুলো বিশেষ করে মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরি ও মদন উপজেলার বিশাল জলরাশি বর্ষাকালে সমুদ্রের মতো রূপ নেয়। নৌকায় ঘুরে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। শীতকালে এসব হাওরে প্রচুর অতিথি পাখির আগমন ঘটে, যা পাখিপ্রেমীদের জন্য দারুণ আকর্ষণীয়।
৪. দখলাকোণা রাজবাড়ি ও রোয়াইল বাড়ির ঐতিহাসিক স্থাপনাঃ
নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় অবস্থিত দখলাকোণা রাজবাড়ি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা, যা স্থানীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাক্ষ্য বহন করে। আরও রয়েছে মহাদেবপুর জমিদার বাড়ি, রোয়াইল বাড়ি ঈষা খাঁ দূর্গ যা পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হতে পারে।
পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাঃ
নেত্রকোনার পর্যটন শিল্প উন্নয়নের জন্য এখানে রয়েছে অসংখ্য সম্ভাবনা।
১. ইকো-ট্যুরিজমের বিকাশ
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে নেত্রকোনায় ইকো-ট্যুরিজমের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে হাওর, নদী, পাহাড় ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকেন্দ্রগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা পর্যটকদের টানতে পারে।
২. সাংস্কৃতিক পর্যটনঃ
গারো, হাজংসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনধারা, ঐতিহ্য ও উৎসব পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারে। নেত্রকোনায় সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজন করা গেলে পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটবে।
৩. এডভেঞ্চার ট্যুরিজমঃ
গারো পাহাড়, সুমেশ্বরী নদী, বালিঝুড়ি ও লেংগুরা অঞ্চলে ট্রেকিং, রক ক্লাইম্বিং, নৌকাভ্রমণের সুযোগ বাড়ানো গেলে এডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য এটি দারুণ গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে।
৪. ধর্মীয় পর্যটনঃ
নেত্রকোনায় রয়েছে বহু ধর্মীয় স্থাপনা, যেমন রানীখং মিশন, শিবগঞ্জের শিবমন্দির, বারহাট্টার শ্যামসুন্দর আখড়া। এসব ধর্মীয় স্থান উন্নত ও প্রচার করলে দেশ-বিদেশের ধর্মপ্রাণ পর্যটকদের আকর্ষণ করা সম্ভব।
বিপুল সম্ভাবনার পাশাপাশি নেত্রকোনার পর্যটন শিল্প বিকাশের পথে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন—
১.পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও মানসম্মত হোটেল-রিসোর্টের অভাব।
২.রাস্তা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা
পর্যাপ্ত প্রচারণা ও পর্যটন সংক্রান্ত তথ্যের অভাব।
৩.পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতার ঘাটতি।
এসব সমস্যা সমাধানে নেওয়া যেতে পারে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ।
যেমনঃউন্নত হোটেল, রিসোর্ট ও রেস্টুরেন্ট স্থাপন,পর্যটনবান্ধব রাস্তা ও পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়ন,
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেত্রকোনার পর্যটন স্থানগুলোর প্রচারণা বৃদ্ধি।
স্থানীয় জনগণের পর্যটন-সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহন করা।
নেত্রকোনার পর্যটন শিল্প বিকাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সঠিক প্রচারণার মাধ্যমে নেত্রকোনাকে একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা সম্ভব। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করলে এই শিল্প জেলার অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
লেখকঃ মোঃ নাজমুল ইসলাম (সাংবাদিক ও লেখক)

