মোঃ নাজমুল ইসলাম
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত নেত্রকোনা জেলা এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রকৃতি এবং কালের বিবর্তনে নানা আন্দোলন-সংগ্রামের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই জনপদ। গারো পাহাড়ের কোলঘেঁষা, নান্দনিক হাওর-বাওড়বেষ্টিত এই অঞ্চল একদিকে যেমন কৃষিনির্ভর, তেমনি লোকসংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়ে ভাস্বর।
নেত্রকোনার ইতিহাসের শিকড় বহু গভীরে। প্রাচীনকালে এই অঞ্চল কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে ধারণা করা হয়। এরপর পাল, সেন ও মোঘল শাসনামলে নেত্রকোনা ছিল গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, মোঘল আমলে এই অঞ্চল মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং এখানে নীলকর সাহেবদের একচেটিয়া ব্যবসার কারণে নীল চাষ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছিল।
ব্রিটিশ শাসনামলে নেত্রকোনা অঞ্চল বিভিন্ন কৃষক আন্দোলন ও সামাজিক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাব এখানে পড়েছিল, তবে তা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। পরবর্তী সময়ে তেভাগা আন্দোলন ও নানান কৃষক বিদ্রোহের মাধ্যমে নেত্রকোনা কৃষকশ্রেণির সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হয়ে ওঠে।
ব্রিটিশ শাসনামলে নেত্রকোনা অঞ্চল কৃষক বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ এবং স্বদেশী আন্দোলনের একটি কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় নেত্রকোনার জনগণ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠে। ১৯৩০ সালের চৌগাঙ্গা বিদ্রোহ এই অঞ্চলের কৃষকদের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোনার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল মোহনগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। ৯ ডিসেম্বর নেত্রকোনা হানাদারমুক্ত হয়। এই জেলায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য গেরিলা আক্রমণ চালিয়েছিলেন। বারহাট্টা, দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, মোহনগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
নেত্রকোনা জেলার ভূপ্রকৃতি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। জেলার উত্তরাংশে রয়েছে মেঘালয়ের পাহাড়, যা দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলায় বিস্তৃত। অপরদিকে দক্ষিণের অংশে রয়েছে বিস্তীর্ণ হাওর-বাঁওড়।
নেত্রকোনার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হলো এখানকার হাওর অঞ্চল। মিঠামইন, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী, বারহাট্টা ও কেন্দুয়া উপজেলায় বিস্তৃত হাওরগুলো বর্ষাকালে সাগরের রূপ নেয় এবং শীতকালে পরিণত হয় বিশাল চারণভূমিতে।
জেলার উল্লেখযোগ্য নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে কংস, সোমেশ্বরী, মগরা, ধনু, উব্দাখালী ও বাউলাই নদী। এই নদীগুলো একসময় যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল মাধ্যম ছিল।
নেত্রকোনার অন্যতম ঐতিহ্য লোকসংগীত। বাউল, ভাটিয়ালি, জারি-সারি, পালাগান এই অঞ্চলের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
নেত্রকোনার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। ধান, পাট, সরিষা ও শাকসবজি চাষ এই জেলার প্রধান কৃষিকাজ। এছাড়া মৎস্যচাষ ও গবাদি পশুপালন এখানকার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি এলাকা প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। এখানে সোমেশ্বরী নদীর স্বচ্ছ নীল জলরাশি এবং গারো পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
নেত্রকোনা শুধু একটি জেলা নয়, এটি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অনন্য ধারক। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা, লোকসংস্কৃতির ঐশ্বর্য, কৃষিনির্ভর জীবনযাত্রা ও পর্যটনের সম্ভাবনা—এসব দিক থেকে নেত্রকোনা বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা। যদি এর পর্যটন, সংস্কৃতি ও কৃষির উন্নয়নে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে এটি হয়ে উঠতে পারে দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ জনপদ।

