
-দেলোয়ার হোসেন মাসুদ
৫ ডিসেম্বর ২০২৪।
সকালবেলা কুয়াশা আর রোদ্দুরের মাঝে দোল খেতে খেতে আমরা বের হলাম দিনাজপুরের রাজবাড়ি আর রাজ মন্দির দেখতে। সঙ্গে ছিলেন বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক অনূপ সাদী। উদ্দেশ্য: ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখা। ফলাফল: ইতিহাস আমাদের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধুলোমাটি মেখে দিল!
প্রথমে ঢুকলাম রাজ মন্দিরে। ভেবেছিলাম মন্দিরে ঢুকলে মাথা নিচু হবে ভক্তিভরে, কিন্তু ভিতরে ঢুকেই বুঝলাম, মাথা নিচু হবে ঠিকই… তবে তা চোরা গর্ত আর ভাঙা মেঝেতে না হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার জন্য। সেখানে কিছু পরিবার আস্তানা গেড়েছে। ইতিহাসের গায়ে তারা সাবলীলভাবে মাছ কুটছে, পেঁয়াজ কুটছে, পাঁপড় তেরি করে শুকাচ্ছে আর আমাদের দিকে কুটকুটি চোখে তাকাচ্ছে।
“এখানে দেখাশোনার জন্য কেউ আছে নাকি?”— জিজ্ঞেস করতেই একজন মহিলার চোখ যেন মেঘে ঢাকা বিদ্যুৎ চমকালো।রুক্ষস্বরে বললো,
“না এখানে কেউ নাই? যাও গা, ভিডিও টিডিও কইরো না!”
প্রসঙ্গত, সেই মুহূর্তে আমাদের দলের একজনের ক্যামেরা ছিল বন্ধ, আর মন খোলা। কিন্তু মহিলার ধমকে ক্যামেরা চালু আর মন বন্ধ হয়ে গেল।
মন্দির থেকে ইতিহাসের ভার বহন করে সরাসরি গেলাম রাজবাড়ি দেখতে। ঢুকেই মনে হলো, আমরা কোনো প্রাসাদে নয়, যেন ‘ভুতুড়ে অ্যাডভেঞ্চার পার্কে’ ঢুকেছি। কোথাও বনের রাজত্ব, কোথাও কলাগাছ, কোথাও পাকা জামগাছের নিচে ভাঙা বীম-কলাম পড়ে আছে— যেন রাজা রাজবাড়ি না, কাঠমিস্ত্রির দোকান চালাতেন!
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কোনো নমুনা নেই। তবে গুজব আছে— এখানে একসময় পৃষ্ঠপোষক ছিল কাঠবিড়ালি ও পাখিরা। বর্তমানে সেগুলোও অন্য জেলায় বদলি হয়েছে।
আরেকটু হেঁটে সামনে দেখি “শিশুপরিবার” লেখা একটি আধুনিক দালান। শুনলাম হুইপ সাহেব নির্মাণ করেছেন। পাশে রানিপুকুর। কল্পনায় রানি আসেন, হাঁটি হাঁটি পা পা করে পুকুরে পা ডোবান। বাস্তবে দেখি পুকুরে ছেলেরা ডোবায় পলিথিন।
রাজবাড়ির বর্তমান দশা দেখে একজন দর্শনার্থী দার্শনিক ভঙ্গিতে বললেন,
“বুঝলা ভাই, এটাই ইতিহাস… আগে যাদের ছিল রাজবাড়ি, এখন তাদেরই জায়গায় বসবাস করে ছাগল আর ভেড়া।”
আমি বললাম, “আর যারা ইতিহাস লিখে, তারা এখন ব্যস্ত ফেসবুকে রিল বানাতে।”
সবশেষে আমাদের ফেরার সময় এক বৃদ্ধ বললেন,
“আরে বাবা, এত কষ্ট করে আসছো, কিছু খেয়ে যাও।”
জিজ্ঞেস করলাম, “কি খাব?”
উনি বললেন, “ইতিহাস… ধুলোমাখা, বেমালুম বিস্মৃত ইতিহাস।”
দিনাজপুরের এই রাজবাড়িটি আমাদের এক অতীত ঐতিহ্য, যার বর্তমান পরিচয়— “ভবিষ্যতে আর কিছুই থাকবে না!”
সরকারি স্বীকৃতি না থাকলে ইতিহাসও আজকাল আইডি কার্ড ছাড়া স্কুলে ঢুকতে পারে না।
